পেন্সিলে লিখা বাবার ডায়েরি (ধারাবাহিক উপন্যাসঃ পর্ব-১১)
লিখেছেন লিখেছেন মামুন ০৭ ডিসেম্বর, ২০১৪, ০৬:৩৫:১৬ সন্ধ্যা
মিথিলা বাবু!
কত কিছু খুটিনাটির ভিতর দিয়ে যে বড় বড় ফাটল গুলি চোখের উপর উঠে আসে! জীবনকে দেখার জন্য চোখ থাকতে হয়। দেখতে চেষ্টা কর। স্পেশাল একটা দিনের কথা বলি। আমার যেদিন পুরোপুরি চোখ ফুটল, নিজের অবস্থানকে যেদিন দেখলাম!
সেদিন মা বারান্দায় রোদে মোড়ায় বসে চাঁপাকে সরিষার তেল মালিশ করছিলেন। বাবা অফিসে যাওয়ার পথে মা'কে বললেন,' আজ রাতে বিচার। তোমার ছেলেকে ঘর থেকে বের হতে নিষেধ করে দিও।' কথাটা মা'র পাশে বসা আমিও শুনলাম। মা সরিষার তেলের বাটিটা নামিয়ে রেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন , " মানুষের চাল চলন ভিন্ন হয়, কথা বার্তায় অমিল হয়, , সব মানুষের জীবন এক হয় না , চিন্তা ও আলাদা হয়, মানুষে মানুষে তবু কিছু মিল তো থাকে! সেই মিলটুকু যদি কেউ মনে রাখত! মরতে তো হয় সবাইকেই! অন্তত মানুষের আখিরাতের খেয়ালটা যদি থাকত! এরা বোধ হয় জানে না যে এরাও মরবে! '
মা আমার দোষ দেখছিলেন না। যদিও গোলমালটা ঘরে এনেছিলাম আমি। অনিচ্ছায়।
আমার ক্লাস নাইনের শেষ তখন। ফুটবল খেলা নিয়ে আমাদের এলাকার দুটি দলের ভিতরে গন্ডগোল হয়ে যায়। ইন্টার স্কুল খেলা ছিল। খেলার শেষের দিকে সবাই কম বেশি উত্তেজিত ছিল। ওই দলের একজন ফাউল করে বসল। আমরা প্রতিবাদ করলাম। রেফারি আমাদের পক্ষে রায় দিলেন। ওরা রেফারিকে তো মানলোই না, আমাদের একজনকে কলার ধরে ঝাঁকিয়ে ধমকাতে শুরু করল। যাকে ধরেছিল সে ছিল রুস্তম পরিবারের ছেলে বাবর, যে ধরেছে সে সৈয়দ বাড়ির ছেলে শিপনের সবচেয়ে কাছের বন্ধু। শিপনরা আমাদের বিপক্ষ স্কুলে। শিপন নাক গলাতেই ব্যাপারটা রুস্তম পরিবারের ছেলের সাথে সৈয়দ পরিবারের ছেলের গোলমালে রূপ নিল। শেষে বাবর আর শিপনের ভিতরে মাঠের ভিতরেই তুমুল মারপিট হল। দর্শকদের মধ্যে দুই পরিবারের যারা ছিল তারাও মাঠে নেমে গেল। খেলা পন্ড হয়ে গেল। কর্তৃপক্ষ দুই পক্ষকে ছাড়িয়ে দিয়ে খেলা থেকে দু'জনকেই বাদ দিলেন। খেলার জন্য আরেকটা দিন স্থির করে দিলেন। মাঠ শান্ত হল, মারামারিটা খেলার মাঠে শেষ হয়ে গেল না। সেদিনই রাতে নামাযের পর পাড়ার মসজিদের সামনের রাস্তায় মুরুব্বিদের মধ্যে ব্যাপারটা নিয়ে আরেক দফা কথা কাটাকাটি হয়ে গেল। মহল্লার দুইচারজন মুরুব্বি উপযাচক হয়ে বিচার ডাকলেন।
এরপর সেটা অনেক দূর গড়ায়। স্বাভাবিকভাবে প্রভাবশালী পরিবার প্রভাবশালীদের সমর্থন পেলো। পথে ঘাটে হেটে যেতে কথায় বার্তায় তুলনামূলক ভাবে দুর্বল পরিবারের লোকজনের মুখে রুস্তমের জন্য যেটুকু সহানুভুতি বোঝা গেল তা প্রকাশ করার সাহস কেউ করল না। ব্যাপারটা হলো এমন, যেন দুই স্কুল কর্তৃপক্ষসহ দুটো মহল্লার বড় মানুষেরা বাবরকে শাস্তি দিতে এলো। বাবরের গোয়ার্তুমি ছিল, কিন্তু তার অপরাধের তুলনায় শাস্তির আয়োজন দেখে আশ্চর্য হলাম।
মিথিলা বাবু, বিচারপতির বিচার কে করবে?
বুঝলাম, সকালে মা কেন দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলেন। মা ও জানতেন, বিচারে অবিচার হবে। আমিই জানতাম না!
সৈয়দ পরিবারের মুরব্বিরা আমি যে দলে ছিলাম তাদের সাথে একটু বেশী রুষ্ট হন। মারামারিটা বাবর একটু বেশী ই করেছিল, কারণ তার ভাই নিহত হয়েছিল এদের ছেলেদের হাতে। কিন্তু বাবর আমার বন্ধু ছিল। আমার টানটা বাবরের জন্যই বেশি ছিল। ফুটবল খেলার ঘটনাটা বড় হওয়ার পিছনে যে বড় কারণটা ছিল তা নিয়ে কেউ কথা বলতে চাচ্ছিল না। বরং সেই ঘটনাটার ব্যাপারে কথা বলায় বিচারে রুস্তম পরিবারের ছেলে বাবরের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়। সেই বিচার স্কুল মাঠেই হয়। সৈয়দদের একমাত্র জীবিত মুরব্বী বিচারক। রুস্তমদের কেউ আসে নাই। শুধু ওদের তিন ছেলে যাদের ভিতরে একজন আসামি হয়েছে। আর আমিও আসামি। তোমার দাদাভাই অনেক চেষ্টা করেন নিজের ছেলেকে বাঁচাতে । এজন্য তিনি সৈয়দদের সাথে গোপনে দেখা করেন। বাসায় এসে আমাকে বলেন এই ব্যাপার থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে।
বিচারের দিনে উপস্থিত সবাই সৈয়দদের নাইনে পড়ুয়া ছেলে শিপনের সব দোষ রুস্তমের ছোট ছেলের উপর চাপিয়ে দেয়। আমি আসল কথাটি বলা শুরু করতে চাইলে বাবা এবং সৈয়দদের উপস্থিত মুরব্বিরা কথা শুনতেই চায় না। এসময় বাবরকে স্কুলের বেত দিয়ে ২০টি বেত্রাঘাতের রায় দেয়া হয়। তবে সে ক্ষমা চাইলে, তাঁকে ক্ষমা করা যেতে পারে, বলে জানানো হয়।সে উদ্ধত থাকে। বাবর বলে, 'আমি কোনো অন্যায় করি নাই। শিপন আগে শুরু করেছে, আমি কেন ক্ষমা চাইবো?' এর উত্তরে ঐ পক্ষ শিপনের দোষ ঢাকে । পরিস্থিতি বাবরকে আরো ক্ষেপিয়ে তোলে। এক পর্যায়ে বাবর বলে, 'আমার ভাইয়ের খুনিদের কাছে কোনো ক্ষমাপ্রার্থনার প্রশ্নই উঠে না!'এতে সৈয়দদের মুরব্বী জাফর সাহেব ক্ষেপে যান। তিনি অকথ্য ভাষা ব্যবহার করেন। এবং তক্ষুণি ওকে বেত্রাঘাত করার আদেশ দেন। শিপনের কোন শাস্তি হল না!
উপস্থিত সকলের সামনে এক একটি বেতের আঘাত করা হয় বাবরের হাতে। এক একটি আঘাত আর প্রতি আঘাতে বাবরের কেঁপে উঠার সাথে সাথে আমার পৃথিবীটা কেঁপে উঠছিল। প্রতিটা আঘাতের পর আমি বাবার চোখে তাকাচ্ছিলাম। বন্ধুকে বাঁচানোর ক্ষমতা ছিল না আমার। .. প্রতিটি আঘাতে আমার মন বিদ্রোহ করছিল। প্রতিটি আঘাত যেন প্রতিক্রিয়াশীল শোষক শ্রেণীর বিরুদ্ধে প্রচন্ড এক আক্রোশে আমার হৃদয়কে আকাশ কাঁপিয়ে ডাক দিচ্ছিল, জাগিয়ে তুলছিল! আর বাবরের হৃদয়টা কঠিন তো আগেই হয়েছিল, এই আঘাত ওকে আরো ভয়ংকর করে তুলেছিল। সে প্রচণ্ড কষ্টকে সয়ে যাচ্ছিল, দুচোখ দিয়ে এক ফোটা পানিকেও সে পড়তে দিলো না। এতটা অমানুষিক কষ্ট! ... পূর্ণবয়ষ্ক লোকের ২০টি গায়ের জোরে বেতের আঘাত একজন নাইন পড়ুয়া ছেলে সেদিন কিভাবে সহ্য করেছিল, ভেবে পাই না।
এই ঘটনার পরে বাবার সাথে আমার সম্পর্ক অনেক বেশি খারাপ হয়ে যায়। খাবার টেবিলে বসে বাবা যখন বললেন, ' রুস্তমদের ছেলে বাবরের সাথে যেন আর না দেখি তোমাকে ' কেন জানি সেদিন জীবনে প্রথমবার বাবার মুখের উপর কথা বলে ফেললাম। সেটা না বোধকই ছিল। বাবা জীবনে কখনো আমার গায়ে হাত তুলেন নাই, কিন্তু সেদিন বেশ জোরে একটি থাপ্পড় লাগিয়ে দিয়েছিলেন। সেই ই প্রথম এবং সেই ই শেষ। এরপরে আমরা দু'জন মনে মনে আরো অনেক দূরে সরে গেলাম।
বাবার সেই থাপ্পড়টাকে সেদিন মনে হয়েছিল শোষন আর শক্তির দম্ভের প্রতি বাবার আনুগত্য, সমর্থন। ছেলের জন্য দুশ্চিন্তার প্রকাশ ও যে হতে পারে তা মনে হচ্ছিল না। সেই থেকে বাবার মধ্যে ভালো কিছুই আর দেখতে পাচ্ছিলাম না। আমার চোখে বাবা হল শাসক, আমি শাসিত!
শুরু হল ঘরে আমার পুরোপুরি বিদ্রোহী জীবন। আবিষ্কার করলাম আমি নিজেকে দুই ভাগ করে ফেলেছি, ' জলে বাস- কুমির নয়, জলের সাথে বিবাদ'! অনুভুতি শাঁখেরকরাত হয়ে কাটতে লাগল। বাবার পরিচয় বহন করছি, তাকেই আবার স্বীকার করতে পারছি না। তাকে আঘাত করছি, আবার সেই আঘাতে নিজে কষ্ট পাচ্ছি। কিছুতেই আর মিশতে পারছি না! কোনমতেই নিজেকে ছাড়াতেও পারছি না! আমি একজন মানুষ দু'জন হয়ে গেলাম। একজন সবল শ্রেণীর অংশ , অন্যজন দুর্বল শ্রেণীর। এক দ্বৈত জীবন। আসলে দুইয়ে মিলে আমি বোধ হয় এই দূটো ধারা থেকে ভিন্ন আরেক ধারার মানুষ হয়ে গেলাম!
আর বাবার দিক থেকে আমার আচরণটা কেমন দেখাচ্ছিল? আজীবন ন্যায়ের পক্ষে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো বাবা যখন নিজের আসল পরিচয় হারিয়ে নিজেকে এটা ওটা বলে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন তখন আমার প্রতিবাদে তিনি আমার মধ্যে কি নিজের ছবি দেখছিলেন?
আমার আঘাতগুলি তার বাইরেটাকে যত বেশি কঠিন করে তুলছিল ভিতরটাকে ততটাই কি ভংগুর করে তোলেনি?
(ক্রমশঃ)
বিষয়: সাহিত্য
৯৫১ বার পঠিত, ১৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
তাই নিজেকে আবার নতুন করে পুনর্বিন্যাস করলাম। এবং কেবলমাত্র সামনে ই এগিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম।
ভালো থাকবেন আপনি। শুভকামনা রইলো।
আপনার অনুভূতি রেখে গেলেন, অনেক শুভেচ্ছা রইলো।
শুনে অনেক খুশী হলাম।
সাথে থাকার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
বারাকাল্লাহু ফিকুম।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
ভালো থাকবেন।
পারিপার্শিক কত কারণেই মানুষ দ্বৈত জীবন গ্রহনে বাধ্য হয়! অনেক কষ্টের তা!
আমার বিশ্বাস ছিল- আপনি থাকতে পারবেন না সবাই কে ছেড়ে! সত্য হওয়াতে আলহামদু লিল্লাহ!
নিরন্তর শুভ কামনা!!
আপনার সুন্দর ধারণার জন্য মোবারকবাদ।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
মন্তব্য করতে লগইন করুন